দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা
জন্ম-মৃত্যু : ১৯১৯-১৯৯০
দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার ১৯১৯ সালের ১৯ জুলাই ( ৩ শ্রাবণ ১৩২৬ বাংলা ) হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার ( তৎকালীন সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার বাহুবল থানার ) স্নানঘাট গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাদের পরিবার দুহালিয়া রাজবংশের উত্তরপুরুষ তাঁর পিতার নাম মরহুম আব্দুল গনি চৌধুরী এবং মায়ের নাম মরহুমা সাহেলা খাতুন চৌধুরী। তিনি পিতামাতার তৃতীয় সন্তান।
১৯৩২ সালের দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন কথাশিল্পী মিরজা আব্দুল হাই। ষষ্ঠ শ্রেণীতে বাংলা পড়াতেন দীনেশ বাবু। তিনি ঝড়ের সময় কবিতা লেখার জন্য ছাত্রদের উপদেশ দিয়েছিলেন। দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা গ্রীষ্মের ছুটিতে অনেক কবিতা লেখেন এবং বন্ধের পরে তাঁর বন্ধু মিরজা আব্দুল হাইকে দেখান। সে বছর বিদ্যালয় বার্ষিকীতে তাঁর কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়। সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতাই তিনি প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। তখন স্কুল পাঠ্যবই পড়ার চেয়ে কবিতা,গল্প ও উপন্যাস পড়ার অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠেন। কোথাও কোন বই এর সন্ধান পেলে কয়েক মাইল হেঁটে বইটি সংগ্রহ করে পড়তেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতাই তাঁকে অধিকতর আকৃষ্ট করে।
ষাটের দশকে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা কবিতা লেখা,ছড়া,গল্প লেখায় ও জাদুঘর স্থাপনে ব্রতী হন। তিনি বেশ কিছু গল্প লেখেন। তখন দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর কবিতা,ছড়া ও গল্প ছাপা হতে থাকে। তিনি ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব অধ্যয়নে ব্রতী হন। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সংগ্রহে মনোযোগী হন। ১৯৬৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর নিজ বাসগৃহে তিনি স্থাপন করেন আহরনী জাদুঘর । জাদুঘর উদ্ভোধন করেন হবিগঞ্জ তৎকালীন মহকুমা প্রথম মুনসেফ জনাব এ.এফ.এম আহসান উদ্দীন।
সত্তরের দশকে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা ইতিহাস,প্রত্নতত্ত্ব, লিপিতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী এবং বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের জীবন সদস্য পদ লাভ করেন এবং সভা সমিতিতে গভেষনামূলক প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আশির দশকে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা বিশ্বপরিবার গঠনের স্বপ্ন দেখেন ও এ ব্যাপারে কিছু লেখালেখি করেন। তাঁর বক্তব্য ইংরেজি পত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব, মার্কিন রাষ্ট্রপতি, সোভিয়েত রাষ্ট্রপতিসহ অনেকের কাছে প্রস্তাব প্রেরন করেন। তাঁর প্রস্তাব সমূহ “ A Proposal for World Peace and Universal Brother Hood ” শীর্ষক সংকলনে সংকলিত হয়েছে। তাঁর উদ্যোগে ১৯৮৩ সালের ১৯ মার্চ তাঁর জন্মস্থান স্নানঘাটে অনুষ্ঠিত হয় স্বনির্ভর পরিবার ইউনিটের প্রথম গ্রীষ্ম সম্মেলন। এই সম্মেলন তিনি ঘোষণা করেন যে, সারা বিশ্বের সকল মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে এবং বিশ্বে শান্তি আসবে।
১৯৮৯ সালের ঢাকাস্থ হবিগঞ্জ এসোসিয়েশন দেওয়ান গোলাম মোর্তাজাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ঐতিহ্য পরিষদ তাঁকে ঐতিহ্য পুরষ্কার ১৩৯৭ প্রদান করে । এছাড়া হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, শ্রীমঙ্গল ও স্নানঘাটের বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছে। বাংলা একাডেমীতে জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে এক ঘণ্টার এক ভিডিও ক্যাসেট তৈরি করেছে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে যে কয়জন প্রাক্তন ছাত্র, কৃতি ছাত্র সংবর্ধনার আয়োজন করে তিনি তাঁর পুরোধা ছিলেন। এই উপলক্ষে প্রকাশিত তৎসম্পাদিত “ শতাব্দীর শতদল ” হবিগঞ্জের শিক্ষা অঙ্গনে এক মূল্যবান দলিল।
হবিগঞ্জ সুরবিতান ললিতাকলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে এবং সাহিত্য সংগত, শব্দ শিল্পী গঠনে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার ভূমিকা প্রশংসনীয়।
১৯৮৯ সালের শেষের দিকে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার তাঁকে কর্কট রোগে আক্রান্ত বলে ঘোষনা করায় তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তাঁর নিজ কর্মস্থল জার্মানিতে যাওয়ার অনুরোধ করেন। ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে তিনি জার্মানিতে গমন করেন। সেখানকার স্ত্যাট্রিম এ ক্লিনিকে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৯০ সালের ১৩ই জুলাই।
হবিগঞ্জ নাগরিক কমিটি এমন একজন সাহিত্যঅনুরাগীকে সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছে। আজ এই সম্মাননা গ্রহন করবেন দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার ভাতিজা জনাব পারভেজ চৌধুরী।