ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদের মরদেহ ঘিরে রোববার ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে ব্যতিক্রমী এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
চিন্তাধারা ও মতবাদের গভীর বিভাজনের এই সময়ে নানা মতাদর্শের মানুষজন তার প্রতি শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে এক জায়গায় এসেছিলেন। সকাল দশটার দিকে সাদা ফুলে সাজানো একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মরদেহ নিয়ে আসার আগেই ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম মানুষজন জড়ো হতে থাকেন। হাতে করে ফুল নিয়ে এসেছিলেন প্রায় সবাই। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল, দেশি ও বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী – সকল ধরনের মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। সবাই তাকে ‘আবেদ ভাই’ বলে তাকে সম্বোধন করছিলেন। উন্নয়ন খাতে তার সমসাময়িক আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনুস তাকে স্মরণ করে বলেন, “মানুষের জীবন পরিবর্তনে যত কিছু লাগে, প্রত্যেক কাজে তিনি শরীক হয়েছেন। শুধু কয়েকটা ছোটখাটো দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য নয়, সকল মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে গেছেন, এবং তিনি সফল হয়েছেন।” ড. ইউনুস মনে করেন বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় সবাই কোন না ভাবেই স্যার আবেদের সঙ্গে জড়িত। “তার প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচী, তার প্রতিষ্ঠান যে সেবা দেয় কোন না কোন ভাবে আমরা সবাই তার সাথে জড়িত।” শিক্ষা গবেষক রাশেদা কে চৌধুরী বলছেন, তিনি নেতৃত্ব তৈরি করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। “তিনি প্রত্যন্ত এলাকার মাঠের থেকে তুলে নিয়ে এসেছেন নারী নেতৃত্ব। এটাতো বিরল। আমরা নেতৃত্ব বলতে উপরের দিকের লোকজন বুঝি। কিন্তু উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নারী নেতৃত্বের বিকাশ তৃনমূলে হলে এটার সর্বোচ্চ ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।” রাশেদা কে চৌধুরী তার একটি উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, “তিনি একবার গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে একদল কিশোরী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো স্যার আপনি ছোট শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন কিন্তু আমাদের জন্য কী কিছু করবেন না? এরপর ফিরে এসে তিনি কিশোরী ক্লাব খুলেছিলেন। এখন তাদের অনেকেই স্থানীয় পর্যায়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমনকি নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েছেন।” “উনি বিশ্বাস করতেন কর্মসংস্থানের আগে শিক্ষাটা প্রয়োজন। যদি শিক্ষা ও কর্মসংস্থান একসাথে হয় তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন অবশ্যম্ভাবী।” শুধু নারীর ক্ষমতায়ন নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ রোধ, ক্ষুদ্র ঋণ, দারিদ্র বিমোচন এরকম নানা বিষয়ে স্যার আবেদ কাজ করে গেছেন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের দ্বারপ্রান্তে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পৌঁছে দিয়েছেন। তার সংস্থা ব্রাকের কর্মীরা সারা দেশ থেকে আজ দলে দলে হাজির হয়েছিলেন তাকে সম্মান জানাতে। তাদের একজন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে একটি প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রিফাত আরা। তিনি বলছেন “আমরা একটু আগেই আলাপ করছিলাম যে উনি কেমন ভিশনারি মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক কিছু অনেকের আগে দেখতে পেয়েছেন, সেটা শিক্ষা বলেন, স্বাস্থ্য বলেন। তবে তাঁর অন্যতম দক্ষতা ছিল কমিউনিটিকে জড়িত করা, তাদের একসাথে নিয়ে আসা। মানুষকে বোঝাতে পারা যে তাদের সম্ভাবনা কী।” স্যার আবেদের প্রতিষ্ঠিত উন্নয়নের মডেল বিশ্বের অনেক দেশে অনুসরন করা হয়। তিনি ব্র্যাককে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে গেছেন। বিশ্বের ১১ টি দেশে এখন ব্রাকের কর্মসূচী রয়েছে। যার একটি বড় অংশ আফ্রিকাতে। বিশ্বব্যাপী তৃনমূলের স্বাস্থ্যকর্মীদের নেটওয়ার্ক পিপলস হেলথ মুভমেন্টের বাংলাদেশ অংশের ভাইস চেয়ার সামিয়া আফরিন বললছিলেন কীভাবে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের কাজকে নিয়ে গেলেন। “গ্লোবাল লেভেল পর্যন্ত তিনি যে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে গেছেন, এর পেছনে অন্যতম বিষয় ছিল তিনি সুদূর প্রসারী চিন্তা করতেন, স্বপ্ন দেখতেন। বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন খাতের মানুষজনের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি অনেক দেশে যেতেন। বিভিন্ন দেশের চিত্র সম্পর্কে ওনার একটা ধারনা ছিল। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রয়োজনটা চিহ্নিত করতে পেরেছেন।” স্যার ফজলে হাসান আবেদের পরিচয়ের সাথে চলে আসে ব্রাক ছাড়াও আরও অনেকগুলো সংস্থার নাম। তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুধু গড়ে তোলা নয়, সেগুলোর বিস্তৃতি এবং সফলভাবে টিকেয়ে রাখার বিষয়ে তার দক্ষতার কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা দা হাঙ্গার প্রজেক্টের বাংলাদেশ প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলছেন, “বাংলাদেশিদের একটা দুর্নাম হল আমরা গড়ি কিন্তু স্থায়িত্ব দিতে পারি না, চলমান রাখতে পারি না। অনেক সংগঠনই গড়ে উঠেছে যারা প্রথম দিকে অবদান রেখেছে কিন্তু তা চলমান থাকেনি। আবেদ ভাই সেটা পেরেছেন, সেটাই তার ছ থেকে বড় শিক্ষণীয় বিষয়।” তার মতে, “আরেকটা শিক্ষণীয় বিষয় হল, আমরা উত্তরাধিকার সৃষ্টি করতে পারি না। তিনি এই বিষয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন।”