২৯ দিন একটানা কানাডার কারাগারে থাকতে হল সিলেটের হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গে জন্ম নেওয়া, ও বেড়ে ওঠা ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসকে (যিনি রমানাথ নামেও পরিচিত), কারণ ইমিগ্রেশনের অদ্ভুতুড়ে আইন- সেই সাথে সালটা ১৯৩২, ভারতবর্ষের অধিবাসীদের জন্য দুয়ার খোলা নেই কোথাওই!
৫ ফুট ৪ ইঞ্চির 'চিরকুমার' মানুষটাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার জাত আছে কি নেই? উনি উত্তর দিয়েছিলেন - 'আমার জাত চলে গেছে, শুধু আছে বাঙালিত্ব। এটাই শুধু যায় নি।
সাইকেলে ৫৩ হাজার, পায়ে হেঁটে ৭ হাজার, রেলগাড়িতে ২ হাজার এবং জাহাজে ২৫ হাজার, মোট ৮৭ হাজার মাইল (১ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার) ভ্রমণ করা মানুষটি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, সর্বভুক, ভীষণ সাহসী, নির্লোভ। (তাঁর সাইকেলের সাথে Hindu Traveler লেখা থাকতো রাজনৈতিক কারণে কিছু দেশে ঘোরার সময় সন্দেহমুক্ত থাকার জন্য)
তাঁর সাইকেলটি ছিল কিছুটা জার্মান, অনেকটা জাপান এবং ফ্রি-হুইলটা ইংল্যান্ডের। ফলে যেমন মজবুত, তেমনি গতি উঠত শন্-শন্ করে। সিঙ্গাপুরে শেষ একমাস নিজেই খোলা-পরা-সারানো শিখে নিয়েছিলেন। পিছনের কেরিয়ারে মাঝারি সাইজের কাঠের বাকস বাঁধা থাকতো। যার মধ্যে ছিল সাইকেল সারানোর যন্ত্রপাতি ও টুকিটাকি জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা। এটি অবশ্য চলার পথে সুন্দর করে তৈরি করে দেন চিনের সীমান্ত শহর 'আন্তং' এর প্রবাসী ভারতীয় বৃদ্ধ বাসিন্দা মিঃ আল্লাদিত্যা। সাইকেলটির ফ্রেম ত্রিভুজের মাঝে ঝোলানো বোর্ডে অর্ধবৃত্তাকারে লেখা থাকতো "রাউন্ড দা ওয়ার্লড্, অন্য দিকে হিন্দু ট্রাভেলার।
বলতেন অর্থের প্রতি লোভ করলেই আর পর্যটন হয় না, লোভীরা কখনও ভ্রমণ করতে পারে না। বিচিত্র সব কোমল-কঠিন অভিজ্ঞতা সারা জীবনে - চীনে বিপ্লব চলাকালীন সময়ে মাও সে তুং-এর সাথে দেখা করেছেন প্রবল উচ্ছাসে, আফ্রিকায় হায়েনার সাথে একই জলায় জলপান করেছেন, বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়ে পাশে কোন শ্বেতাঙ্গ না বসায় একা বাসে চেপে দেখতে গিয়েছেন নায়াগ্রা, ভাড়াটে খুনের গুলির সামনে পড়েছেন, বিস্তর আঘাত পেয়েছেন শরীরে ও মনে।
তাঁর বিচিত্র সব ভ্রমণের গল্পের জন্য অপেক্ষা থাকতো সারা বাঙ্গালি জাতি, যাদের মধ্যে গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। ৩২টি বই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ভবঘুরে জীবন নিয়ে। রামনাথের পৃথিবী গ্রন্থ থেকে জানা যায় ভূপর্যটক ১৯৪০ সালের ২৬ শে এপ্রিল বিশ্ব ভ্রমণ শেষ করে একদিন বিশ্বকবিকে তাঁর ভ্রমণের ঐতিহাসিক বিশ্বজয়ী বাইসাইকেলটি উপহার দিতে শিলাইদহের রবীন্দ্র কুটিরে যান। উদ্দেশ্য-বিশ্বজয়ী সাইকেলটি বিশ্বকবিকে উপহার দিয়ে নিজে ধন্য হবেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বললেন, রামনাথ তোমার লেখা আমি পড়ি অবিশ্বাস্য ছোট এই বাক্যটুকু কানে পৌছানো মাত্র চিরাচরিত স্বভাব তেড়ে ফুঁড়ে আছড়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্ত ইনি যে স্বয়ং রবি ঠাকুর বলে কথা। তবু শত হলেও রামনাথ বটে। মেঝের দিকে নতদৃষ্টিতে মাথা চুলকে বহু চেষ্টাকৃত ধীর গলায় উগরে দিলেন-গুরুদেব অধমের কাছে মিথ্যা বলে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? এক পলক অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে মুচকি হেসে গুরুদেব হাঁকলেন-অনিল, ‘দেশ’ পত্রিকাগুলো নিয়ে এসে দেখাওতো পর্যটক মশাইকে। কবির প্রিয় পাত্র অনিল চন্দ ত্বরিতে দেশ বেশ কয়েকটি তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলে রামনাথ সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, তারই লেখা পাতার পর পাতা আন্ডার লাইন করা। লজ্জা সংকোচে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। মসৃণ আয়না সদৃশ রামটাকে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে এবং চমকে চমকে উঠে ভাবছেন, এও কি সম্ভব। আমার মতো অধম লেখকের লেখা বিশ্বকবি এভাবে পড়েন।
দেশভাগের পরও তিনি সিলেটের বানিয়াচঙ্গেই অবস্থানের চেষ্টা করেছিলেন, পরে নানা পরিস্থিতিতে একেবারেই কোলকাতা চলে যেতে বাধ্য হন, সেখানে একটি প্রকাশনা সংস্থা দিয়ে নিজের বই প্রকাশ করেছিলেন বেশ কয়েকটা। ১৯৫৫ সালে মাত্র ৬১ বছর বয়সে অন্য জগতে ভ্রমণে চলে যান।
ভূমিকায় লেখা ছিলো লেখক শ্যামসুন্দর বসু প্রচুর পরিশ্রম করেছেন রামনাথ বিশ্বাস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে। তিনি বিভিন্ন উপাদান নানা সূত্র থেকে সংগ্রহ তো করেছেনই, উপাদানের সাথে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন নানা ক্ষেত্রে। এমনকি লেখক বিশ্বাস মশায়ের জন্মভূমি সিলেটের বানিয়াচং গ্রামেও গিয়েছেন নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। মূল্যবান বইটি ১৯৯৭ সালে কলকাতার সজনি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, রামনাথ বিশ্বাসের জীবন ও কর্ম আরও মনোযোগ ও গবেষণার দাবি রাখে।
পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেন, রামনাথ বিশ্বাস যেন কানে ফিসফিস করে বলতেই থাকে, “দেশ দেখা যার একমাত্র কাজ, তার আবার হারিয়ে যাওয়া কী?”