হবিগঞ্জের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্র সিপাহশালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রঃ)
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সে শ্রেষ্টত্ব অর্জন করতে মানুষকে অনেক সাধনা করতে হয়। আর সাধনা করে মানবতার চরম শিখরে উঠে অন্যায় দূরীভূত করে, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজ পুনর্গঠন করে মানবতার্থে প্রমান স্থাপন করে গেছেন যারা তাদের মধ্যে অন্যতম সিপাহশালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রঃ)। তাঁদের পরশে মানুষ পেয়েছে নবচেতনা।
সিলেট তথা বাংলায় মুসলিম জাগরণের পথিকৃত ৩৬০ আউলিয়া। তাদের মধ্যে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অন্যতম সঙ্গী ছিলেন নাসির উদ্দিন (রহঃ)। তিনি সিলেট বিজয়ে প্রধান সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন। শাহজালাল (রঃ) – এর নির্দেশে তিনি তরফ তথা বর্তমান হবিগঞ্জ বিজয় করেন। তিনি ঐতিহাসিক মুড়ারবন্দে রেখে গেছেন তাঁর শ্রেষ্ট কীর্তি। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার খোয়াই নদী বিধৌত মুড়ারবন্দ নামক স্থানে তার মাজার অবস্থিত।
দিল্লীর বাদশাহ সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ ১৩০৩খ্রিষ্টাব্দে সিকান্দার গাজীকে সেনাপতি করে গৌড় রার্জ জয়ের জন্য পাঠালেও তিনি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়ায় পরবর্তীতে নাসির উদ্দিন (রঃ) – কে সেনাপ্রধান করে প্রেরন করেন। পতিমধ্যে শাহজালাল (রঃ) এর সাথে তার দেখা হয় এবং সবাই মিলে গৌর জয়ে আসেন। রাজা গৌর গোবিন্দের সন্ধির ফলে শাহজালাল (রঃ) এর নির্দেশে তিনি নাসির উদ্দিন (রঃ) ভারী ধনুকে ‘জ্যা’ যোজন করেন এবং আযান দেন। ফলে রাজপ্রাসাদ গুলো ভেঙ্গে যায় এবং পরে তিনি তরফ তথা বর্তমান হবিগঞ্জ অঞ্চল জয় করতে যান।
বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার অধিকাংশ, ব্রাহ্মনবাড়ীয়ার কিয়দাংশ, ত্রিপুরার উত্তর পূর্বাংশ নিয়ে ছিল তৎকালীন তরফ রাজ্য। বর্তমান ভারত, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী খোয়াই নদীর তীরে বাল্লর নিকটবর্তী বিষগাঁও নামক স্থানে ছিল তৎকাীলন তরফ রাজ্যের রাজধানী। সে সময় তরফ রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন আচক নারায়ণ। তার রাজ্যে নূর উদ্দিন নামে এক লোককে তার ছেলের বিয়েতে গরু জবাই করার কারনে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এ খবর পেয়ে শাহজালাল (রঃ) নাসির উদ্দিন তিন হাজার পদাতিক এবং এক হাজার অশ্বরোহী সৈন্যবাহিনী নিয়ে তরফ জয়ের জন্য নির্দেশ দেন। তখন তার সাথে ছিলেন বার জন আউলিয়া। যার কারণে তরফ রাজ্যকে বার আউলিয়ার দেশ বলা হয়। এই বিশাল বাহিনী নিয়ে যখন নাসির উদ্দিন (রঃ) বিষগাঁয়ে পৌঁচেন তখন অবস্থা বেগতিক দেখে আচক নারায়ণ সন্ধির প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। তাই আচক নারায়ণ পলায়ন করে ত্রিপুরায় চলে যায়। ফলে তরফ রাজ্য সিপাহশালার নাসির উদ্দিন (রঃ) ও তার অনুসারীদেও অধীনস্থ হয়। যখন নাসির উদ্দিন (রহঃ) তরফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন প্রথমে তিনি তরফ রাজ্যের সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবতরণ করেন। যার কারণে ঐ স্থানটির নাম উচ্চ আইল বা উচাইল রাখা হয়। তা বর্তমানে একটি পরগণা। আচক নারায়ণের পলায়নের পর নাসির উদ্দিন (রঃ) সৈন্য – সামন্ত নিয়ে রাজধানীতে প্রবৃষ্ট হন এবং সেখানে অবস্থান করেন। কিন্তু সেই জলবায়ূ উপযোগী না হওয়াতে অনেক সৈন্য মারা যান। তাই তৎখনাৎ সেনাপতি সে স্থান থেকে ১০ মাইল দূরে বর্তমান লস্করপুর নামক স্থানে অবস্থান করেন। কথিত আচে লস্কর বা সৈন্য অবস্থানের কারণেই এই স্থানের নমি লস্করপুর রাখা হয়। তরপ রাজ্য জয়ের খবর দিল্লীতে পৌঁছলে সম্রাট নাসির উদ্দিন (রঃ) এর কাছে তরফ রাজ্যর শাসনভার অর্পণ করেন। তার সাতে যে ১২ আউলিয়া এসেছিলেন তাদের অনেকে বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচারার্থে চলে যান। তাদের মধ্যে শাহ গাজী (রঃ) এর মাজার রয়েছে চুনারুঘাটের গাজীপুরে, শাহ মজলিশ আমিন (রঃ) এর মাজার রয়েছে হবিগঞ্জের উচাইলে এবং সেখানে সুলতানী আমলের একটি মসজিদে রয়েছে। শাহ ফতেহ গাজী (রঃ) রয়েছে মাধবপুরের শাহজীবাজারে। পরে নাসির উদ্দিন (রঃ) মুড়ারবন্দনামক স্থানে ইবাদত বন্দেগীর জন্য আস্তানা করেন এবং সেখানেই তিনি ওফাত লাভ করেন। মুড়ারবন্দেই তাকে দাফন করা হয়। তার মাজার এখনও মুড়ারবন্দে রয়েছে। সারাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ এখনও তার মাজার জিয়ারতের জন্য মুড়ারবন্দ আসেন। তাই মুড়ারবন্দেও এই মাজারকে সংরণ করা হলে একদিকে যেমন হবিগঞ্জের ঐতিহাসিক নিদের্শন সংরণ হবে, অন্যদিকে এটাকে পর্যটনীয় স্থান হিসেবে গঠন করা যাবে।