সৈয়দ আহমদুল হক (পইলের সাব)
জন্ম-মৃত্যু : ১৯৪৯-২০২০
১৯৪৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামের সাহেব বাড়িতে জন্মগ্রহণ,
13 march 2020 রাত ১-৩০ মিনিটে নিজ বাড়ীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
হবিগঞ্জের এই আলোকিত ও নন্দিত রাজনীতিবিদের জীবনবৃত্তান্তের অংশবিশেষ।
জনসেবক সৈয়দ আহমদুল হক (১৯৪৯)
হবিগঞ্জের নন্দিত রাজনীতিবিদ সৈয়দ আহমদুল হক যিনি সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। কিন্তু তিনি জনগণের আশা আখান্কা বাস্তবায়নে সদা তৎপর থাকেন বলে বার বার জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এতটাই জনবান্ধব হয়ে উঠেছেন যার ফলে তাকে জনগনের রাজনীতিবিদ বলতেই হয়। অসাধারন জনপ্রিয় এই মানুষটি বার বার বিনা প্রতিদন্দিতায় নির্বাচিত হয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
সৈয়দ আহমদুল হক ১৯৪৯ সালের ৩১ জানুয়ারী হবিগঞ্জ সদর থানার ইতিহাস খ্যাত পৈল গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ জাহেদুল হক ছিলেন একজন ধার্মিক মানুষ ও এলাকাবাসীর নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়জন। জনাব আহমদুল হক ১৯৬৮সালে বৃন্দাবন কলেজ থেকে বিকম পাশ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি সমবায় বিভাগে চাকুরী লাভ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তার কর্মস্থল ছিল সুনামগঞ্জ মহকুমায়। সেখান থেকে বদলী হয়ে আসেন নিজ শহর হবিগঞ্জে। নিজ গ্রামের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও দেশসেবক বিপিন চন্দ্র পালের কীর্তিময় জীবন তাঁকে বেশ আলোড়িত করে। সেই খ্যাতিমান বিপিন পালের জীবনের গৌরবগাথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা ও স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে স্থাপন করেন ‘বিপিন পাল স্মৃতি পাঠাগার’। এভাবেই শুরু হয় তাঁর জনসম্পৃক্ততা।
১৯৮৩ সালে এলাকাবাসী তাঁকে চাকুরী ছেড়ে পুরাপুরি জনসেবায় আত্মনিয়োগ করতে অনুরোধ করে।কিভাবে? উত্তর খুব সহজ,জনগনের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি জনসেবক হতেই সিদ্ধান্ত নেন। নিরাপদ সরকারী চাকুরী ছেড়ে দেন এক লহমায়। এলাকাবাসীর আহবানে ঐ বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেন। ব্যাপক ভোটে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিকে হারিয়ে পৈল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সৈয়দ আহমদুল হক। সেই থেকে গত ৩০ বছর যাবৎ অনুষ্ঠিত কোন নির্বাচনেই তিনি পরাজিত হননি। ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২য় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তখন তাঁর বিপক্ষে অন্য কোন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হয়নি। ফলে তিনি প্রথমবারের মতো বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে সরকার উপজেলা পরিষদ ভেঙ্গে দেয়। তারপর ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন । সেখানেও এলাকাবাসী তাঁকে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে। এরপর যতবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ততবারই তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত ৩য় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ায়নি। তিনিই নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ৪র্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও তিনিই বিজয়ী। একজন মানুষ কতটা জনপ্রিয় হলে এভাবে বার বার নির্বাচিত হতে পারে সহজেই অনুমেয়। মুল কথা হলো তিনি সর্বদা জনগনের পাশে থাকেন। কথায় ও কাজে জনগনকে কখনো ধোকা দেননা। সরকারী অর্থ নিজের কল্যানে ব্যয় করা তো দূরের কথা তা চিন্তাও করেননা। তাঁর ভদ্র ও নম্র আচরণে মানুষ এতটাই মুগ্ধ যে আম জনতার নিকট তিনি হয়ে উঠেন ‘পৈলের সাব’। ‘সাবের ’ প্রতি তারা এতটাই মুগ্ধ যে তাঁর জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয়না। নিকট অতীতে এর প্রমানও তারা দিয়েছে।
একজন জনপ্রতিনিধি কিভাবে জনগনের সেবক হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরন সৈয়দ আহমুদুল হক। তিনি সকলের বিশ্বস্থ।তারা মনে করে ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নাও হতে পারে কিন্তু ‘সাব’এর কাছে নিরাপদ। একটি মানুষ কতটা সৎ হলে এমন আস্থা অর্জন করতে পারে তার উদাহরনও তিনি নিজেই। সৈয়দ আহমদুল হক জীবনে এলাকার অসংখ্য বিবাদের বিচার সালিশ করে নিরপেক্ষতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যে মামলা কোর্ট কাছারীতে আপোষ হয়না সে মামলাও তিনি অবলিলায় নিস্পন্ন করে দেন যেখানে উভয় পক্ষই আনন্দ চিত্তে তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। তাঁর বিচক্ষণতা ও কঠোর নিরপেক্ষতাই সকলের নিকট তাঁকে গ্রহনযোগ্য করে।
জনসেবার জন্য শুধু এলাকাবাসীর ভালবাসাই পাননি ,সরকারের তরফ থেকেও তাঁর সৎ কর্মের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি তিনবার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান মনোনীত হয়ে সরকারী পদক লাভ করেছেন।বলা যায় পৈল গ্রামে বিপিন পাল তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী রেখে গিয়েছেন। বর্তমান প্রজন্ম তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা গ্রহন করে এগিয়ে যাবে এটাই কামনা।।
সৈয়দ আহমদুল হকের কাছে সালিশ বিচারের ৩২ কোটি টাকা আমানত!
পইলের সাব’ বললে আর কোন পরিচয়ের দরকার হয় না। হবিগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ এই নামেই তাকে চিনে, যার আসল নাম সৈয়দ আহমদুল হক। সাদা মনের মানুষ হিসেবে যিনি জেলার সকল মানুষের কাছে অর্জন করেছিলেন আস্থা আর বিশ্বাস। যে কারণে জেলা জুড়ে একজন ন্যায় বিচারক হিসেবে তিনি গড়েছিলেন বিশেষ খ্যাতি। আর এ বিশেষ খ্যাতির সর্বশেষ অবস্থা শুনে বিস্মিত হয়েছেন জানাযার নামাজে অংশ নেয়া লাখো মুসল্লী ও ভক্ত আশেকান।
জানাযার নামাজ পূর্ববর্তী মরহুম সৈয়দ আহমুদল হকের ছেলে পইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঈনুল হক আরিফ বলেন, ‘তার বাবা সারাটি জীবন সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও গণমানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করে গেছেন। জীবনের শেষ মুহুর্তে এসেও তিনি এ লক্ষ্যে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ থাকার পর বাড়িতে এসে মৃত্যুর তিন দিন পূর্বেও তিনি তার কর্মময় জীবনের আমানত থাকা বিভিন্ন সালিশ ও বিচারকার্যের প্রায় ৩২ কোটি টাকার হিসাব কাগজে কলমে স্পষ্ট করে লিখে গেছেন। যা মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাকে অবগত করে গেছেন’।
এসময় সৈয়দ মঈনুল হক আরিফের এমন বক্তব্য শুনে জানাযার অংশ নেয়া লাখো মুসল্লী বিস্মিত হয়ে যান। অনেককেই মন্তব্য করেন, পইলের সাব হওয়ার কারনেই এটি তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। যে কারো পক্ষে এটা সম্ভব নয়। আবার অনেকেই বলেছেন পইলের সাবের কাছে হাজার কোটি টাকা থাকলেও একটি পয়সা খেয়ানত হবে না সেই বিশ্বাস রেখেইে মানুষ তার কাছে টাকা পয়সা আমানত হিসেবে রাখতো।
উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামের সাহেব বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ আহমদুল হক। বাবা সৈয়দ জাহেদুল হক ছিলেন পইল ইউনিয়নের বারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। আহমদুল হক ১৯৬৮ সালে বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে বিকম ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কয়েক বছর একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। একপর্যায়ে জনগণের চাওয়ার মূল্যায়ন করতে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে নির্বাচন করে কয়েক টার্ম পইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৫ সালে প্রথম সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন। এরপর সবক’টি উপজেলা নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। সেখানেও চার বার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, বেশ কিছু দিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার উন্নত চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে কোন উন্নতি হয়নি। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে পইল গ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন।